শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন
অনেকেই ভুলক্রমেই হোক কিংবা কোনো প্রয়োজনেই হোক যেমন নিজের ব্যবসা ,ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য বা বিভিন্ন দরকারী কাজে টিআইএন রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন এবং পরবর্তীতে টিআইএন সার্টিফিকেট বাতিল করতে চান। আপনি অনলাইনে যেমন সহজেই টিআইএন সার্টিফিকেট তৈরি করে ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু চাইলেই অনলাইনে ঘরে বসে বাতিল করতে পারবেন না। আপনাকে যথাযথ নিয়ম মেনেই টিন বাতিল করতে হবে। কেউ কেউ এটিকে টিন সার্টিফিকেট নথিজাতকরণও বলে থাকেন। টিন সার্টিফিকেট কেন বাতিল করতে চান তার উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে, আপনি যে অঞ্চলে থেকে টিন সার্টিফিকেট তৈরী করেছেন, সে অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার বরাবর আবেদন করতে হবে। উপকর কমিশনার নিজে বা অন্য কারও দিয়ে টিন সার্টিফিকেট বাতিলের বিষয় তদন্ত করতে পারেন কিংবা শুনানী করতে পারেন অথবা আবেদনের উপর ভিত্তি করে আপনার টিআইএন এর কার্যক্রম স্থগিত বা বাতিল করতে পারেন।
তবে একটি বিষয় আপনাদের জেনে রাখা দরকার যে, টিআইএন সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন করলেই আয়কর দাখিল করতে হবে এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। টিন সার্টিফিকেটের সাথে ইনকাম ট্যাক্্র এর কোন সম্পর্ক নেই। আপনার আয় আয়কর রিটার্ণ দাখিলের সীমার মধ্যে আছে কি-না দেখে নিতে হবে। প্রথমত মাসিক আয় ১৬০০০ টাকা ক্রস করলে টিন সার্টিফিকেট খুলতে হবে এবং শুধুমাত্র রিটার্ণ দাখিল করতে হবে, আয়কর নয়। মনে রাখবেন আয়কর দাখিল আর রিটার্ণ দাখিল এক বিষয় নয়।
অন্যদিকে আপনার বার্ষিক আয় ২,৫০,০০০/- টাকা ক্রস করলে আপনাকে সর্বনিম্ন ৩,০০০ টাকা আয়কর রিটার্ণ দাখিল করতে হবে উপজেলার ক্ষেত্রে। আপনার আয় আয়কর সীমার নিচে নেমে গেলে আপনি শুধুমাত্র রিটার্ণ দাখিল করবেন, আয়কর নয়। আরেকটি বিষয় জানার দরকার, কেউ মারা গেলে তার টিন সার্টিফিকেট কি করবেন। ধরুন, আপনার বাবা একজন ভাল ব্যবসায়িক ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর টিআইএন বাতিল করার প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করবে তার উত্তরাধিকারীদের উপর। যদি এমন কোন ব্যবসা বাবার নামে থাকে যা টিআইএন বাতিল করিলে ব্যবসা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র বাতিল করে নতুন করে করতে হয় কিংবা বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয় সে ক্ষেত্রে টিআইএন বাতিল না করে উত্তরাধিকারীরা প্রতিবছর বাৎসরিক রিটার্ন জমা দিয়ে এ্যাসেসমেন্ট করাতে পারবেন। আর যদি টিআইএন এর কোন প্রয়োজনীয়তা না থাকে তাহলে উত্তরাধিকারীরা উপকর কমিশনার বরাবর টিআইএন বাতিলের জন্য আবেদন করিতে পারেন।
এখন জানার বিষয় আয়কর রিটার্ণ জমা না দিলে কী বিপদ হবে আর এর সমাধানই বা কী? টিআইএন নম্বর থাকার অর্থ কর দেবার উপযুক্ত হোন অথবা না হোন, অর্থবছর শেষে তার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের একটি খতিয়ান, অর্থাৎ আয়কর রিটার্ণ জমা দিতে হবে রাজস্ব বোর্ডে। টিআইএন নম্বর থাকা সত্বেও আয়কর রিটার্ণ জমা দেন না, কয়েক বছর ধরে দেননি কিংবা নানা কারণে দিতে পারেননি। এর ফলে আপনি বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন। যদি কোন ব্যক্তি সময়মত আয়কর রিটার্ণ দিতে ব্যর্থ হন এক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী এক হাজার টাকা অথবা আগের বছরের ট্যাক্সের দশ শতাংশ জরিমানা করা যাবে। এ দুটির ভেতরে যেটি পরিমাণে বেশি সেই অংকটি পেনাল্টি বা দন্ড হতে পারে। শুধু তাই নয়, কয়েক বছর ধরে যদি কেউ রিটার্ণ দাখিল না করেন তাহলে ওই জরিমানা ছাড়াও যতদিন ধরে তিনি রিটার্ণ দেননি ওই পুরো সময়ের দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে জরিমানা হতে পারে। তবে তা যতদিনই হোক না কেন নতুন করদাতা হলে সবমিলিয়ে জরিমানার পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার উপরে নেয়া হবে না। আর পুরনো করদাতা হলে আগের বছর যে পরিমাণ অর্থ আয়কর হয়েছে সেটিসহ ওই অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দিতে হতে পারে। সেকারণ ঝামেলা এড়াতে প্রতি বছর সময় মতো রিটার্ণ জমা দেয়া আবশ্যক। কিন্তু কোন কারণে যদি তা না দিতে পারেন তাহলে রিটার্ণ জমা দেয়ার জন্য দুই মাস পর্যন্ত বাড়তি সময়ের আবেদন করতে পারেন। এই আবেদন করতে হবে উপ-কমিশনার বরাবর। যদি বাড়তি সময় দেয়া হয় তাহলে রিটার্ণ জমা দেবার সময় জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। তবে যদি কেউ বাড়তি সময় না নেয় তাহলে তাকে পেনাল্টি বা দন্ড দেবার আগে, কী কারণে রিটার্ণ দেননি বা দিতে পারেননি সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য অবশ্যই শুনানির সুযোগ দিতে হবে। শুনানির জন্য করদাতাকে নোটিশ পাঠানো হয়। যদি করদাতা কোন গ্রহণযোগ্য কারণ, কাগজপত্র দেখাতে পারেন তাহলে খুব একটা ঝামেলায় তাকে পড়তে হয় না। কর্তৃপক্ষ কারণ শুনে সন্তুষ্ট হলে জরিমানা নাও করতে পারেন। শুনানিতে করদাতা নিজে অংশ নিতে পারেন অথবা সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। আর জরিমানা হলে তার বিপক্ষে করদাতার আপিলের সুযোগ রয়েছে। কর কমিশনার ও ট্রাইব্যুনালে আপিল করার পরও যদি করদাতা হেরে যান তাহলে হাইকোর্টেও আপিল করতে পারেন। জরিমানার অর্থ জমা দেয়ার জন্য কর অফিসের একটি নির্ধারিত ফর্ম রয়েছে। সেটি পূরণ করে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংকে ক্যাশ, অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেক, পে অর্ডার করে এই অর্থ জমা দিতে হবে। অথবা উপ-কর কমিশনারের কাছে সরাসরি অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেক কিংবা পে- অর্ডার দিতে পারেন। যারা একদমই কর দেন না আর যারা করযোগ্য হওয়ার পরও একেবারেই কর দেন না, তাদের ক্ষেত্রে, তিন ধরনের জরিমানা করা যায়। একটি হল যে পরিমাণ কর বকেয়া হয়েছে সেটি ছাড়াও আরও ২৫ শতাংশ বাড়তি জরিমানা করার বিধান রয়েছে। এমনকি জেল জরিমানার বিধানও রয়েছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে সম্পদ জব্দ করার সুযোগ পর্যন্ত আইনে রয়েছে। যদি কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ী কর জমা না দেয় তাহলে অনেক সময় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পদ জব্দ করার উদাহরণ বেশ রয়েছে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ইমেইল:seraj.pramanik@gmail.com,মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮